বঙ্গবন্ধু ও নতুন প্রজন্ম
ড. মো. আখতারুজ্জামান
লেখক: উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক: উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর জীবনসঙ্গিনী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিবারসহ (দু’কন্যা ব্যতীত) শাহাদতবরণ করেন। সাম্প্রদায়িক ঘাতক-চক্র সাড়ে তিন বছরের প্রস্তুতিতে অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়। এ খুনিচক্রের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রতিশোধ নেওয়া। গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি জাতির জনক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি যাঁরা ১৫ই আগস্ট শাহাদতবরণ করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধচেতনা, উগ্র-সাম্প্রদায়িক দর্শন-ভিত্তিক পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ঘাতক খুনিচক্র জাতির জনককে হত্যা করলো বটে; কিন্তু এক সুমহান বাস্তবতা ও সত্য আজ আমরা উপলব্ধি করি আর সেটি হলো ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’। একেবারেই ঠিক, এটি নিছক একটি শ্লোগান নয়— নিরেট বাস্তবতা। আজকে যখন দেখি হাজার হাজার শিক্ষার্থী, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, কোমলমতি শিক্ষার্থী দেশ ও জাতির কল্যাণে গণমানুষের স্বার্থে রাস্তায় নেমে আসে— তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা মনে পড়ে। কেননা, বঙ্গবন্ধু তাঁর কৈশোরে, স্কুল-জীবনে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সামষ্টিক স্বার্থে আন্দোলন করেছেন। ন্যায্য ও যৌক্তিক কথাগুলো স্পষ্টভাবে ক্ষমতাধরদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
যে কারণে যখন সমাজ ও রাষ্ট্রে কোনো সংকট দেখা দেয় তখন আমরা জাতির জনককে স্মরণ করি এবং তাঁর জীবন-দর্শনের, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করি। এটি নিঃসন্দেহে জাতির জনকের এক চলমান, বহমান ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে যুগ-যুগান্তরের প্রভাব। বঙ্গবন্ধুর সমকালীন অনেক রাজনীতিবিদ বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্ত হতেন, বঙ্গবন্ধু বিভ্রান্ত হতেন না; নিজ সুমহান মূল্যবোধে অটল থাকতেন। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জীবনেও সমপ্রতি তা লক্ষ করা গেল; তাদেরকে অনেক অশুভ শক্তি গুজব ছড়িয়ে, অপপ্রচার চালিয়ে বিপদগামী, বিভ্রান্ত ও সহিংস করার প্রয়াস নিয়েছিল, কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি; স্বমর্যাদায় নিজ নিজ কাজে, শ্রেণিকক্ষে ফিরে গিয়েছে।
জাতির জনকের আন্দোলন সংগ্রামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল সত্যনিষ্ঠ থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল থেকে সেসবের পরিচালনা বা নেতৃত্বদান। অন্ধকারের চোরাগুপ্তা পথে প্রতারণার ভূমিকায় অগণতান্ত্রিক দর্শনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করেননি। এটিই ব্যক্তি মুজিবের নিজস্ব নৈতিকতাসমৃদ্ধ মানবিক-চেতনায় উজ্জ্বীবিত এক শক্তিমত্তার মহীরূহ। সম্ভবত এ কারণেই এ মহামানবকে পাকিস্তান দখলদার ও হানাদার বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করতে বা অসম্মান করতে কখনো সাহস পায়নি। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এ সেই কলঙ্কিত রাতেও বঙ্গবন্ধু মুজিব মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাপিষ্ঠ ঘাতকদের বীরেরস্বরে, নায়কোচিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করতে পেরেছেন, ‘কী চাস্ তোরা’?
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ও আন্দোলন-সংগ্রাম-জীবনের আরেকটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো অন্যের প্রতি, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বঙ্গবন্ধুর স্বভাবসুলভ আচরণের ব্যতিক্রমের সাক্ষ্য কেউ দেন না। হানাদার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বললেন, ‘ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি আসুন, দেখুন, কীভাবে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বিচার করুন’। এ কথার মধ্যে কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট— শিষ্টাচার, শালীনতা ও সৌজন্যবোধ প্রস্ফূটিত; প্রতিহিংসাপরায়নতা নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, আইনি কাঠামোয়, আইনের শাসনের প্রতি, বিচার-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এগুলো মূলত, অত্যন্ত সংক্ষেপে, বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনের, রাষ্ট্র পরিচালনার, রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মজীবনের দর্শন।
আমরা অত্যন্ত আশান্বিত যে, বর্তমান প্রজন্মে আজ লক্ষ লক্ষ মুজিব সেনা, মুজিব-ভক্ত মানুষ শহর, গ্রামের সর্বত্র বিরাজমান। তারা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও কর্মময় জীবনের নানাবিধ ঘটনা, অর্জন ও অবদান আনন্দভরে উপভোগ করে। আর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে জান্তে-অজান্তে, কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়। মনে হয় জীবিত ‘বঙ্গবন্ধু-মুজিবের’ চেয়ে মৃত ‘বঙ্গবন্ধু-মুজিব’ আজ অধিকতর শক্তিশালী। আর এসবের মূল কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা ‘মানবতার মাতা’ শেখ হাসিনার বাস্তবধর্মী জীবন-দর্শন, যেখানে ‘বঙ্গবন্ধু-মুজিবের’ প্রতিচ্ছবি মানুষ খুঁজে পায়।
কোন মন্তব্য নেই
আপনার মন্তব্য/মতামত প্রদান করার জন্য ধন্যবাদ।
জয়বাংলা নিউজ.নেট।