অগ্নিকন্যা
আজ একজন মহিলার কাহিনী। না না তিনি দিল্লীর প্রথম মেয়র নারী স্বাধীনতার ঘোষিত প্রতীক স্বামীর নাম-পদবী ব্যবহারকারিনী প্রচারের আলোতে থাকা সেই অসাধারণ মহিলা অরুনা আসফ আলি নন। তিনি কল্পনা দত্ত।
আজ "অগ্নিকন্যা" বিপ্লবী কল্পনা দত্তের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি:
ছবিটা দেখতে দেখতে দাঁতের কোনে পাইপটা কামড়ে রবার্ট সাহেব বললেন, ডিসগাস্টিং, দিস বিউটিফুল লেডি ইস আ টেররিস্ট! আই ডোন্ট বিলিভ। ইউ অল আর ননসেন্স। চট্টগ্রামের ডেপুটি পুলিশ সুপারের চোখে চোখ রেখে গোয়েন্দা অফিসার মিঃ বসু বললেন,সত্যি আমরা ননসেন্স। আমাদের বুকের ওপর বসে এইভাবে বিপ্লবী কাজ চালাচ্ছে, আর আমরা জানতেই পারিনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের কাছে খবর আপনার ওই বিউটিফুল লেডি একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। রবার্টের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তিনি বললেন, এর কেস হিস্ট্রির ফাইলটা দেখি। অ্যান্টি টেররিস্ট শাখার অফিসার ডিউক বললেন, কেস হিস্ট্রি নেই, কারন কোন অপরাধ প্রমান হয়নি। তবে হিস্ট্রিটা শুনুন।
এর বাবার নাম বিনোদবিহারী দত্ত। এইখানের গ্রামের স্কুল থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করলো মেয়েটা। ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হোল। শিক্ষিত পরিবার, দাদু দুর্গাদাস দত্ত বিখ্যাত ডাক্তার। তাই সবাই চাইলো মেয়ে সায়েন্স পড়ুক কলকাতার কলেজে। সেই মতো বেথুন কলেজে ভর্তি হোল সে। ফর্সা ছিপছিপে সাধারনের চেয়ে বেশ লম্বা সুন্দরী মেয়েটি অন্যদের থেকে অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল,সব কিছুতে খুব উৎসাহ। আর বিজ্ঞান গবেষণাতেও আগ্রহের অন্ত নেই।
এখান থেকেই সমস্যার শুরু। বাড়িতে থাকতেই দেশপ্রেমের যে আদর্শের বীজ বপন হয়েছিলো,কলকাতায় তা পেলো জল বাতাস। শতধারায় বিকশিত হোল তা। বিজ্ঞানের সাথে সাথে মাথায় ঢুকল বিপ্লবের পোকা। ক্ষুদিরামের শহীদ হওয়ার কাহিনী,কানাইলাল দত্তের বীরগাথা অনুপ্রানিত করলো তাকে। সে ছাত্রীদের মধ্যে প্রচার করতে শুরু করলো বিপ্লবের বানী,সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করলো সবাইকে। 'ছাত্রী সংঘের' সদস্য হিসাবে নেতৃত্বে এগিয়ে এলো সে। শুনতে শুনতে বারবার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছিল রবার্টের।
স্যার, এই হোল আপনার বিউটিফুল লেডি মিস কল্পনা দত্ত। তবে এখানেই শেষ নয়, কলকাতাতেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার নামের এক বিপ্লবীর। তার মাধ্যমেই চট্টগ্রামে ফিরে সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করে সে। ইয়েস স্যার, গ্রেট টেররিস্ট মাস্টারদা। সদস্য হন তাঁর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির। সক্রিয় ভাবে না হলেও সহযোগী হিসাবে কাজ করছে সে। তাই বলছি এর দিকে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া দরকার। আরও আছে স্যার,চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কেসে গ্রেপ্তার হওয়া রিপাবলিকান আর্মির সদস্য অনন্ত সিং,লোকনাথ বল,গনেশ ঘোষদের সাথে জেলে বেশ কয়েকবার দেখা করেছে সে। আমাদের চরেরা যা বলছে, তাতে নানা সাজে, কারোর বউ, কারোর বোন, কোন সময় পুরুষ সেজে দেখা করেছে। আমরা তখন কিছু বুঝতেই পারিনি স্যার। সন্দেহই করিনি। কিন্তু খবর আছে, বড় কোন চক্রান্তের সাথে যুক্ত হচ্ছে তারা। তাই ওকে নজরে রাখার ব্যবস্থা করার অর্ডার দিন স্যার।
শুরু হোল নজরদারি। সারাদিন বাড়িতেই থাকেন কল্পনা। ঘরের মধ্যে বসে কি কাজ করেন। মাঝে মাঝে রাতবিরেতে কিছু অচেনা মানুষ আসে ওই বাড়িতে। কখন আসে, কবে আসে কোন ঠিক নেই।তাই ট্রেস করা যায়না। কয়েকবার ফলো করে দেখেছে চরেরা, একটু গিয়েই কোথায় যেন মিলিয়ে যায় ওই সন্দেহজনক মানুষ গুলি। একজনকে ধরা হয়েছিলো, পাওয়া যায়নি কিছুই।
১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। চট্টগ্রামের আদালত চত্ত্বর ভিড়ে ঠাসা। আজ লোকনাথ বল, অনন্ত সিং দের আদালতে হাজিরার দিন। চট্টগ্রাম জেল থেকে বেরল প্রিজন ভ্যান। পুলিশ কর্তাদের কাছে খবর গেলো আজ হামলার ছক করছে বিপ্লবীরা। পুলিশ প্রত্যেকটা লোককে সতর্ক ভাবে পরখ করছে। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেলো এক মুসলিম মহিলা বোরখা পরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাদের মধ্যে নজর কাড়ছে তার উচ্চতা। সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর গেলো মহিলা ফোর্স পাঠানোর। অত্যন্ত গোপনে মহিলা পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল এলাকা। চোখের নিমেষে উধাও সেই মহিলা। আদালতের গেটেও বাহিনী ছিল,কিন্তু কোথা দিয়ে কেমন ভাবে পালালো বোঝাই গেলো না। একটু আগে যে শীর্ণ বৃদ্ধা ঘোমটা দিয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো, তিনিই কল্পনা। পুলিশ আবার মিস করলো তাকে। কিন্তু আদালত চত্ত্বর থেকে যা পেলো তা ঘুম উড়িয়ে দিলো পুলিশের। মারাত্মক বিস্ফোরক গান কটন পেলো তারা। কার্পাস তুলোর ওপর নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রন দ্বারা তৈরি এই গান কটন ডিনামাইটের মতো কাজ করে। বিপ্লবীদের প্ল্যান ছিল এই গান কটন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বন্দিদের মুক্ত করা। আর এর গুরু দ্বায়িত্ব পড়েছিল কল্পনার কাঁধে। সতর্ক পুলিশ জেলের মধ্যে থেকেও উদ্ধার করলো ওই বিস্ফোরক। যে পদার্থের ভয়ে বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ,ফ্রেঞ্চ আর্মি কেঁপে যেতো, সেই পদার্থ পোশাকের মধ্যে করে জেলে সরবরাহ করেছে এই দামাল মেয়ে। ভাবা যায়!!
এর পরে পুলিশ গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করলো কিন্তু প্রমানের অভাবে গ্রেপ্তার করতে পারলনা। যতই নজরদারি চালাক, এই মেয়েকে রোখে কার সাধ্য। তিনি সরাসরি যোগাযোগ করলেন মাস্টারদার সাথে। আবেদন জানালেন পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে নামতে চান তিনি। অনেক বোঝালেন সূর্য সেন। কিন্তু তিনি অনড়। শেষে মাস্টারদার উদ্যোগে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নামের দুই বীরাঙ্গনা স্থান পেলেন বাহিনীতে।দেশপ্রেমের আন্তরিকতায়,অদম্য সাহসে,বন্দুক পিস্তলে নিখুঁত নিশানায় মাস্টারদাকে মুগ্ধ করলেন দুই নারী।কল্পনা নতুন বিপ্লবীদের শেখাতে লাগলেন বিস্ফোরক তৈরির পদ্ধতি।
এরপর এলো সেই দিন। ১৯৩২ সাল। মাস্টারদা ঠিক করলেন ব্রিটিশকে পাল্টা আঘাত করতে হবে। পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমন করা হবে। কল্পনার ওপর দায়িত্ব পড়লো ছদ্মবেশে ক্লাবে গিয়ে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ঢোকা বেরনোর পথ দেখে অভিযানের পরিকল্পনা করে আসতে। পুরুষের ছদ্মবেশে ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে অস্ত্র বা কিছু না থাকায় ভবঘুরে অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো তাকে। কথা বের করার জন্য জেলের মধ্যে চলল অকথ্য অত্যাচার, অশ্লীল অপমান। বন্ধ কুঠুরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা, মহিলা পুলিশ দিয়ে দৈহিক নির্যাতন ছিল রোজের ঘটনা। কিন্তু একটি কথা বার করা যায়নি তাঁর থেকে। সব কিছুর মুখে অবিচল ছিলেন তিনি। ২মাস পরে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়।
বেরিয়েই তিনি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিপ্লবী দলে। আত্মগোপন করে থাকার সময় ১৯৩৩ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি গইরালা গ্রামে যখন মাস্টারদা তাঁদের নিয়ে মিটিং করছেন, গোপনে খবর পেয়ে পুলিশ ঘিরে ফেলে। শুরু হয় গুলির লড়াই। অসমসাহসী কল্পনা সামনে থেকে গুলি বৃষ্টি শুরু করেন। দিশাহারা হয়ে যায় পুলিশ। তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু ধরা পড়েন মাস্টারদা। নেতার এই বিপর্যয়ে দলে সংকট দেখা দেয়। শুরু হয় পালিয়ে বেড়ানোর জীবন। তিন মাস পর আবার পুলিশ ঘিরে ফেলে তাঁদের। আবার শুরু হয় লড়াই। এবার পুলিশ অনেক বেশি। তাই কল্পনা সহ গোটা দল ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক, হত্যা নানা অপরাধে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির আদেশ হয়। মহিলা ও বয়স কম বলে কল্পনার ফাঁসি হোলনা। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোল। ১৯৩৯ সালে ছাড়া পেলেন তিনি। জেলে বসেই শুনেছিলেন মাস্টারদার ফাঁসির খবর।তিনি শুধু ব্রিটিশ মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি চেয়েছিলেন দারিদ্রমুক্ত,শোষণমুক্ত ভারত। তাই জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। গরীব প্রান্তিক মানুষদের জন্য কাজ করেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। যুদ্ধ,দাঙ্গা,রোগ মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষের পাশে ছুটে গেছেন বারবার। পাশে পেয়েছিলেন স্বামী ও বিখ্যাত সিপিআই নেতা পি.সি. যোশিকে। ১৯৯৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন এই মহীয়সী নারী।
মরার আগেও বহুবার মরেছেন তিনি। যেদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ( দাঙ্গা বলার জন্য ক্ষমা করবেন। বলা উচিত ছিল genocide) রক্তাক্ত হয়েছিলো নোয়াখালী চট্টগ্রাম, তাঁর সাধের কর্মভূমি,সেদিন মরেছিলেন তিনি লজ্জায়। যেদিন তাঁর চট্টগ্রাম ভারতের বাইরে চলে গেলো, ভাগ হয়ে গেলো দেশ, সেই দিন মরেছিলেন তিনি গ্লানিতে। যখন একের পর এক নেতা নানান কেলেঙ্কারিতে লুটে নিচ্ছিলেন তাঁর সাধের মাতৃভুমিকে তখন অপমানে মরেছিলেন রবি ঠাকুরের আদরের এই 'অগ্নিকন্যা'।
বড় বড় নেতারা সমঝোতা করেছেন ব্রিটিশের সাথে,পেয়েছেন নানা সম্মান,নানা পদ। তাদের কাহিনী,তাঁদের মূর্তি,তাঁদের ইতিহাস পূজিত হয় দেশ জুড়ে। আর আড়ালে থেকে যান এই কল্পনারা। তাঁদের কাহিনী চাপা পড়ে থাকে ইতিহাসের অন্ধকারে। বিস্মৃত বাঙালী ভুলে যায় তাদের অতীত। তবু তাঁরা থাকেন। তাঁদের আদর্শ, তাদের ত্যাগ, তাঁদের অনমনীয় লড়াই লেখা থাকে দেশ মা এর হৃদয়ে। আজ ২৭ জুলাই, ১৯১৩ সালের এই দিনে এই মহান বিপ্লবী কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহন করেন। প্রনাম জানাই তাঁকে।
"যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা/মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা/আজ রক্তকমলে গাঁথা,/আজ রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি,/বিজয়লক্ষী দেবে তাঁদেরি গলে,/মুক্তির মন্দির সোপান তলে,/কত প্রান হোল বলিদান,/লেখা আছে অশ্রুজলে৷"
আজ "অগ্নিকন্যা" বিপ্লবী কল্পনা দত্তের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি:
ছবিটা দেখতে দেখতে দাঁতের কোনে পাইপটা কামড়ে রবার্ট সাহেব বললেন, ডিসগাস্টিং, দিস বিউটিফুল লেডি ইস আ টেররিস্ট! আই ডোন্ট বিলিভ। ইউ অল আর ননসেন্স। চট্টগ্রামের ডেপুটি পুলিশ সুপারের চোখে চোখ রেখে গোয়েন্দা অফিসার মিঃ বসু বললেন,সত্যি আমরা ননসেন্স। আমাদের বুকের ওপর বসে এইভাবে বিপ্লবী কাজ চালাচ্ছে, আর আমরা জানতেই পারিনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের কাছে খবর আপনার ওই বিউটিফুল লেডি একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। রবার্টের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তিনি বললেন, এর কেস হিস্ট্রির ফাইলটা দেখি। অ্যান্টি টেররিস্ট শাখার অফিসার ডিউক বললেন, কেস হিস্ট্রি নেই, কারন কোন অপরাধ প্রমান হয়নি। তবে হিস্ট্রিটা শুনুন।
এর বাবার নাম বিনোদবিহারী দত্ত। এইখানের গ্রামের স্কুল থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করলো মেয়েটা। ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হোল। শিক্ষিত পরিবার, দাদু দুর্গাদাস দত্ত বিখ্যাত ডাক্তার। তাই সবাই চাইলো মেয়ে সায়েন্স পড়ুক কলকাতার কলেজে। সেই মতো বেথুন কলেজে ভর্তি হোল সে। ফর্সা ছিপছিপে সাধারনের চেয়ে বেশ লম্বা সুন্দরী মেয়েটি অন্যদের থেকে অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল,সব কিছুতে খুব উৎসাহ। আর বিজ্ঞান গবেষণাতেও আগ্রহের অন্ত নেই।
এখান থেকেই সমস্যার শুরু। বাড়িতে থাকতেই দেশপ্রেমের যে আদর্শের বীজ বপন হয়েছিলো,কলকাতায় তা পেলো জল বাতাস। শতধারায় বিকশিত হোল তা। বিজ্ঞানের সাথে সাথে মাথায় ঢুকল বিপ্লবের পোকা। ক্ষুদিরামের শহীদ হওয়ার কাহিনী,কানাইলাল দত্তের বীরগাথা অনুপ্রানিত করলো তাকে। সে ছাত্রীদের মধ্যে প্রচার করতে শুরু করলো বিপ্লবের বানী,সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করলো সবাইকে। 'ছাত্রী সংঘের' সদস্য হিসাবে নেতৃত্বে এগিয়ে এলো সে। শুনতে শুনতে বারবার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছিল রবার্টের।
স্যার, এই হোল আপনার বিউটিফুল লেডি মিস কল্পনা দত্ত। তবে এখানেই শেষ নয়, কলকাতাতেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার নামের এক বিপ্লবীর। তার মাধ্যমেই চট্টগ্রামে ফিরে সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করে সে। ইয়েস স্যার, গ্রেট টেররিস্ট মাস্টারদা। সদস্য হন তাঁর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির। সক্রিয় ভাবে না হলেও সহযোগী হিসাবে কাজ করছে সে। তাই বলছি এর দিকে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া দরকার। আরও আছে স্যার,চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কেসে গ্রেপ্তার হওয়া রিপাবলিকান আর্মির সদস্য অনন্ত সিং,লোকনাথ বল,গনেশ ঘোষদের সাথে জেলে বেশ কয়েকবার দেখা করেছে সে। আমাদের চরেরা যা বলছে, তাতে নানা সাজে, কারোর বউ, কারোর বোন, কোন সময় পুরুষ সেজে দেখা করেছে। আমরা তখন কিছু বুঝতেই পারিনি স্যার। সন্দেহই করিনি। কিন্তু খবর আছে, বড় কোন চক্রান্তের সাথে যুক্ত হচ্ছে তারা। তাই ওকে নজরে রাখার ব্যবস্থা করার অর্ডার দিন স্যার।
শুরু হোল নজরদারি। সারাদিন বাড়িতেই থাকেন কল্পনা। ঘরের মধ্যে বসে কি কাজ করেন। মাঝে মাঝে রাতবিরেতে কিছু অচেনা মানুষ আসে ওই বাড়িতে। কখন আসে, কবে আসে কোন ঠিক নেই।তাই ট্রেস করা যায়না। কয়েকবার ফলো করে দেখেছে চরেরা, একটু গিয়েই কোথায় যেন মিলিয়ে যায় ওই সন্দেহজনক মানুষ গুলি। একজনকে ধরা হয়েছিলো, পাওয়া যায়নি কিছুই।
১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। চট্টগ্রামের আদালত চত্ত্বর ভিড়ে ঠাসা। আজ লোকনাথ বল, অনন্ত সিং দের আদালতে হাজিরার দিন। চট্টগ্রাম জেল থেকে বেরল প্রিজন ভ্যান। পুলিশ কর্তাদের কাছে খবর গেলো আজ হামলার ছক করছে বিপ্লবীরা। পুলিশ প্রত্যেকটা লোককে সতর্ক ভাবে পরখ করছে। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেলো এক মুসলিম মহিলা বোরখা পরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাদের মধ্যে নজর কাড়ছে তার উচ্চতা। সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর গেলো মহিলা ফোর্স পাঠানোর। অত্যন্ত গোপনে মহিলা পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল এলাকা। চোখের নিমেষে উধাও সেই মহিলা। আদালতের গেটেও বাহিনী ছিল,কিন্তু কোথা দিয়ে কেমন ভাবে পালালো বোঝাই গেলো না। একটু আগে যে শীর্ণ বৃদ্ধা ঘোমটা দিয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো, তিনিই কল্পনা। পুলিশ আবার মিস করলো তাকে। কিন্তু আদালত চত্ত্বর থেকে যা পেলো তা ঘুম উড়িয়ে দিলো পুলিশের। মারাত্মক বিস্ফোরক গান কটন পেলো তারা। কার্পাস তুলোর ওপর নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রন দ্বারা তৈরি এই গান কটন ডিনামাইটের মতো কাজ করে। বিপ্লবীদের প্ল্যান ছিল এই গান কটন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বন্দিদের মুক্ত করা। আর এর গুরু দ্বায়িত্ব পড়েছিল কল্পনার কাঁধে। সতর্ক পুলিশ জেলের মধ্যে থেকেও উদ্ধার করলো ওই বিস্ফোরক। যে পদার্থের ভয়ে বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ,ফ্রেঞ্চ আর্মি কেঁপে যেতো, সেই পদার্থ পোশাকের মধ্যে করে জেলে সরবরাহ করেছে এই দামাল মেয়ে। ভাবা যায়!!
এর পরে পুলিশ গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করলো কিন্তু প্রমানের অভাবে গ্রেপ্তার করতে পারলনা। যতই নজরদারি চালাক, এই মেয়েকে রোখে কার সাধ্য। তিনি সরাসরি যোগাযোগ করলেন মাস্টারদার সাথে। আবেদন জানালেন পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে নামতে চান তিনি। অনেক বোঝালেন সূর্য সেন। কিন্তু তিনি অনড়। শেষে মাস্টারদার উদ্যোগে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নামের দুই বীরাঙ্গনা স্থান পেলেন বাহিনীতে।দেশপ্রেমের আন্তরিকতায়,অদম্য সাহসে,বন্দুক পিস্তলে নিখুঁত নিশানায় মাস্টারদাকে মুগ্ধ করলেন দুই নারী।কল্পনা নতুন বিপ্লবীদের শেখাতে লাগলেন বিস্ফোরক তৈরির পদ্ধতি।
এরপর এলো সেই দিন। ১৯৩২ সাল। মাস্টারদা ঠিক করলেন ব্রিটিশকে পাল্টা আঘাত করতে হবে। পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমন করা হবে। কল্পনার ওপর দায়িত্ব পড়লো ছদ্মবেশে ক্লাবে গিয়ে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ঢোকা বেরনোর পথ দেখে অভিযানের পরিকল্পনা করে আসতে। পুরুষের ছদ্মবেশে ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে অস্ত্র বা কিছু না থাকায় ভবঘুরে অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো তাকে। কথা বের করার জন্য জেলের মধ্যে চলল অকথ্য অত্যাচার, অশ্লীল অপমান। বন্ধ কুঠুরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা, মহিলা পুলিশ দিয়ে দৈহিক নির্যাতন ছিল রোজের ঘটনা। কিন্তু একটি কথা বার করা যায়নি তাঁর থেকে। সব কিছুর মুখে অবিচল ছিলেন তিনি। ২মাস পরে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়।
বেরিয়েই তিনি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিপ্লবী দলে। আত্মগোপন করে থাকার সময় ১৯৩৩ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি গইরালা গ্রামে যখন মাস্টারদা তাঁদের নিয়ে মিটিং করছেন, গোপনে খবর পেয়ে পুলিশ ঘিরে ফেলে। শুরু হয় গুলির লড়াই। অসমসাহসী কল্পনা সামনে থেকে গুলি বৃষ্টি শুরু করেন। দিশাহারা হয়ে যায় পুলিশ। তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু ধরা পড়েন মাস্টারদা। নেতার এই বিপর্যয়ে দলে সংকট দেখা দেয়। শুরু হয় পালিয়ে বেড়ানোর জীবন। তিন মাস পর আবার পুলিশ ঘিরে ফেলে তাঁদের। আবার শুরু হয় লড়াই। এবার পুলিশ অনেক বেশি। তাই কল্পনা সহ গোটা দল ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক, হত্যা নানা অপরাধে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির আদেশ হয়। মহিলা ও বয়স কম বলে কল্পনার ফাঁসি হোলনা। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোল। ১৯৩৯ সালে ছাড়া পেলেন তিনি। জেলে বসেই শুনেছিলেন মাস্টারদার ফাঁসির খবর।তিনি শুধু ব্রিটিশ মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি চেয়েছিলেন দারিদ্রমুক্ত,শোষণমুক্ত ভারত। তাই জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। গরীব প্রান্তিক মানুষদের জন্য কাজ করেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। যুদ্ধ,দাঙ্গা,রোগ মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষের পাশে ছুটে গেছেন বারবার। পাশে পেয়েছিলেন স্বামী ও বিখ্যাত সিপিআই নেতা পি.সি. যোশিকে। ১৯৯৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন এই মহীয়সী নারী।
মরার আগেও বহুবার মরেছেন তিনি। যেদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ( দাঙ্গা বলার জন্য ক্ষমা করবেন। বলা উচিত ছিল genocide) রক্তাক্ত হয়েছিলো নোয়াখালী চট্টগ্রাম, তাঁর সাধের কর্মভূমি,সেদিন মরেছিলেন তিনি লজ্জায়। যেদিন তাঁর চট্টগ্রাম ভারতের বাইরে চলে গেলো, ভাগ হয়ে গেলো দেশ, সেই দিন মরেছিলেন তিনি গ্লানিতে। যখন একের পর এক নেতা নানান কেলেঙ্কারিতে লুটে নিচ্ছিলেন তাঁর সাধের মাতৃভুমিকে তখন অপমানে মরেছিলেন রবি ঠাকুরের আদরের এই 'অগ্নিকন্যা'।
বড় বড় নেতারা সমঝোতা করেছেন ব্রিটিশের সাথে,পেয়েছেন নানা সম্মান,নানা পদ। তাদের কাহিনী,তাঁদের মূর্তি,তাঁদের ইতিহাস পূজিত হয় দেশ জুড়ে। আর আড়ালে থেকে যান এই কল্পনারা। তাঁদের কাহিনী চাপা পড়ে থাকে ইতিহাসের অন্ধকারে। বিস্মৃত বাঙালী ভুলে যায় তাদের অতীত। তবু তাঁরা থাকেন। তাঁদের আদর্শ, তাদের ত্যাগ, তাঁদের অনমনীয় লড়াই লেখা থাকে দেশ মা এর হৃদয়ে। আজ ২৭ জুলাই, ১৯১৩ সালের এই দিনে এই মহান বিপ্লবী কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহন করেন। প্রনাম জানাই তাঁকে।
"যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা/মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা/আজ রক্তকমলে গাঁথা,/আজ রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি,/বিজয়লক্ষী দেবে তাঁদেরি গলে,/মুক্তির মন্দির সোপান তলে,/কত প্রান হোল বলিদান,/লেখা আছে অশ্রুজলে৷"
কোন মন্তব্য নেই
আপনার মন্তব্য/মতামত প্রদান করার জন্য ধন্যবাদ।
জয়বাংলা নিউজ.নেট।