ছাত্ররাজনীতি করা সব ভাইদের পড়ার অনুরোধ রইল। আগে লেখাপড়া পরে রাজনীতি: গোলাম রব্বানী
প্রিয় অনুজ, স্নেহ-ভালোবাসা নিও। আজ আমি যে কথাগুলি বলছি, তা অন্য কোন রাজনৈতিক অগ্রজ অনুজদের কভু বলেছে কিনা বা আদৌ বলবে কিনা জানা নেই!
আমরা যারা মহামূল্যবান যৌবনের মধ্যগগনে ‘পলিটিকাল’ তকমাটা গায়ে লাগিয়েছি, দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিপ্রায় নিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে লেখাপড়া ও ব্যক্তিজীবনের অন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেই, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা মূলত একটা ঘোরের মধ্যে আছি!
কেউ আদর্শিক টানে, দেশ-জাতি উদ্ধারের মহতী অভিপ্রায়ে, কেউ অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাব প্রতিপত্তির নেশায় দিন-রাত বিরামহীন ছুটে চলে রাজনীতির একটা পরিচয়, পদ-পদবী নামক সোনার হরিণের পিছু। এ নেশা বড় কঠিন নেশা, একবার এ মরীচিকার মায়াজালে জড়ালে তা থেকে বেরিয়ে এসে ‘অরাজনৈতিক’ হয়ে ওঠা বড্ড কঠিন, প্রায় দু:সাধ্য।
কোন পলিটিকাল অনুজকে সে মায়া ত্যাগের কথাও বলছি নাহ, এদেশে ‘অরাজনৈতিক’ ‘নিরপেক্ষ’ বলে কিছু নেই! খোদ নিজে রাজনীতির যে মায়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, তা থেকে বেরোবার পরামর্শ তোমাদের কিভাবে দেই! তবে শুভাকাঙ্ক্ষী অগ্রজ হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কিছু টোটকা দিতে চাই, যা অনাগত আগামীতে তোমাদের করণীয় নির্ধারণে আলবৎ কাজে লাগবে বৈকি!
তোমাদের ‘অপশনাল’ আর ‘কম্পালসারি’র একটা সহজ ফর্মুলা বলি। যেখানে একজন বিচক্ষণ,জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তোমাকে সঠিকটা বেছে নিতে সাহায্য করবে।
এদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সকল চড়াই-উতরাই, আর ইতিহাসের পটপরিবর্তনে ছাত্ররাজনীতির সপ্রতিভ ভূমিকা-অবদান অনস্বীকার্য! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এর গন্ডীতে প্রবেশমাত্র ‘ছাত্র রাজনীতির পাঠশালা’য় তাই তুমি সাদরে আমন্ত্রিত। তবে মনে রেখো, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, বাবা-মা, পরিবারের স্বপ্ন পূরণে তোমার জন্য লেখাপড়াটা কিন্তু মুখ্য!
রাজনীতিসহ অন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিদ্যা অর্জনকে প্রাধান্য দেয়া, জ্ঞান অন্বেষণ করা, ভালো রেজাল্ট করার তাগিদ অনুভব করাটা তাই ‘কম্পালসারি’!
আর যেকোন পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজনীতির চর্চাটা ‘অপশনাল’, মোহের বশে কম্পালসারিকে উপেক্ষা করে কেবল অপশনালের পিছু ছুটলে আম-ছালা দুটো হারানোর শঙ্কা অবশ্যই আছে। ফরজ বাদ দিয়ে নফল নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলে একটা সময় সব হারিয়ে সঠিক উপলব্ধি হলেও সে আত্ম-উপলব্ধি তোমাকে দীর্ঘশ্বাস আর হাহুতাশ ছাড়া কিছুই দেবে না!
চলো ছোট্ট একটা হিসেব কষি, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আরাধ্য চাকরিটির নাম, বিসিএস। সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে আবেদনকৃত প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ ৯০ হাজার, যার বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২৪ ক্যাডারে ২ হাজার ২৪টি শূন্য পদে নিয়োগের সুপারিশ করবে পিএসসি। অর্থাৎ প্রতি ১৯৩ জনে একজন এই আরাধ্য সোনার হরিণের দেখা পাবে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; পৃথিবীর বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। এই সংগঠন এর নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক, সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীর হিসেব কষলে তা কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যদি ৫০ লক্ষের মাঝে অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ লক্ষ সক্রিয় ধরি, তবে মহানগর-জেলা-থানা-ইউনিয়ন সহ সকল ইউনিট মিলে পদধারী নেতার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
এবার ভেবে দেখো, এই ৫০ হাজারের মাঝে রাজনীতিকে কম্পালসারি বিবেচনা করে, রাজনীতিবিদ বা নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে কতজন সফল হয়েছে, আর বড় পদ-পদবী নিয়েও কতজন হারিয়ে গেছে সময়ের অতল গহীনে!
আনুপাতিক হারটা কত? বাস্তবে যদিও আরো কম, তবুও চরম আশাবাদী হিসেবে ধরে নিচ্ছি, কেন্দ্র সহ সকল ইউনিট মিলিয়ে এই ৫০ হাজারের মাঝে ৫ হাজার ছাত্রনেতা নিজেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ২৫ লাখের মাঝে মাত্র ৫ হাজার টিকে থাকে, আনুপাতিক হার প্রতি ৫০০ জনে ১ জন!
অবশিষ্ট ২৪ লাখ ৯৫ হাজার নিজের যৌবনের মহামূল্যবান সময়, শ্রম, মেধা, আবেগ সব ঢেলে দিয়েও একসময় শূন্যহাতে অপাংক্তেয় হিসেব হারিয়ে যায়! ‘টয়লেট টিস্যুর রাজনীতি’তে তাদের ব্যবহারিক উপযোগিতা যে শেষ, মাথাগোনা রাজনীতিতে তাদের প্রয়োজন ততদিনে ফুরিয়ে গেছে!
আর এমন একটা সময় সে রাজনীতি থেকে ঝরে পরে বা বঞ্চিত হয় যখন পড়ার টেবিলে বসার সময় শেষ, সরকারি চাকরির বয়স শেষ, বিয়ের বয়স যায় যায়, নেই কোন সামাজিক পরিচয়, ব্যবসায়ের জন্য নেই কোন পুঁজি। পরিবারের জন্য সে ‘বোঝা’, এতদিন তাকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা বড় নেতা’র কাছে ধরনা দিলে সেখানেও সে একটা ‘উটকো ঝামেলা’!
সে ঘোর অমানিশায় মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতিহিংসা, মামলা-হামলার শিকার হবার ঝুঁকি তো আছেই! সব মিলে দুর্বিষহ হতাশা আর অন্যের করুণা নির্ভর অনিশ্চিত জীবনের হাতছানি!
হ্যা, এটাই বাস্তবতা! আশেপাশে তাকাও, সাবেকদের দেখো, হিসেবটা মিলিয়ে নাও। রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে, বাস্তবতা অস্বীকার করে মনে মনে কলা খেয়ে পথ চলতে গেলে কিন্তু হোঁচট খেতে হবে! আর হোঁচটটা যদি এমন সময় খাও, যখন তোমার আর উঠে দাঁড়াবার, ঘুরে দাঁড়াবার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই, তখন করুণ পরিণতি তো অবশ্যম্ভাবী।
যে পরিমান মেধা-সময়-শ্রম ব্যয় করে তুমি ৫০ লাখের মাঝে পদধারী ৫০ হাজার এর একজন বা সফল ৫ হাজার একজন হবে, তার অর্ধেক এর কম সময়, শ্রম, মেধা তোমাকে দেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বিসিএসে ১৯৩ জনের একজন করতে পারে, তুমি পেতে পারো যেকোনো সরকারী/বেসরকারি চাকরি বা হতে পারো সফল উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
তাহলে কি তোমার ছাত্ররাজনীতিতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত মস্ত ভুল? তোমার ধারণ করা আদর্শের তরে কাজ করার ভাবনা অহেতুক-অমূলক??
কখনোই না! তুমি ‘পলিটিকাল’ হিসেবে সাধারণ আর দশজন শিক্ষার্থীর চেয়ে নেতৃত্বগুণে, সাহসে-মেধা-মননে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘মাচ বেটার’ একজন হিসেবেই সারভাইভ করার সক্ষমতা রাখো নি:সন্দেহে! তোমাকে কেবল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিচক্ষণতার সাথে, একজন ছাত্র হিসেবে লেখাপড়াকে ‘কম্পালসারি’ করে রাজনীতিকে ‘অপশনাল’ ধরে এগোতে হবে। রাজনীতির জন্য কোনভাবেই লেখাপড়ার ক্ষতি করা যাবে না! রাজনীতি থেকে আসবে সেটা ‘বোনাস’।
এমন অনেককেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যারা কেন্দ্রে বড় পদ দখল করে আছে কিন্তু রাজনীতির গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এর সার্টিফিকেটটাও নিতে পারেনি, ছাত্রত্বও শেষ! একবার ভেবে দেখো সাবেক হয়ে গেলে, ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিচয় আর কপালে না জুটিলে তার পরিণতি কি হবে??
মনে রেখো, যোগ্য হিসেবে তোমার প্রাপ্য রাজনৈতিক পদ-প্রাপ্তি চাইলেই কলমধারী কেউ কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু তোমার অর্জিত বিদ্যা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না! তাহলে যে রাজনীতিতে তোমার ভালোমন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতার প্রায় পুরোটাই নির্ভার করছে অন্যের খেয়াল খুশী, ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সেই রাজনীতির জন্য লেখাপড়া ছেড়ে, জীবন-যৌবন উজাড় করে দেয়ার চেয়ে বড় জুয়া আর কি আছে!!
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, ২০১৩ তে আমাদের হল কমিটির সময়ে হল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে আমার মতই যোগ্যতর হিসেবেও পদ বঞ্চিত হয় জিয়া হলের জাহিদুল ইসলাম। শান্তনা পুরস্কার হিসেবে কেন্দ্রের বর্ধিত কমিটিতে একটা উপ-সম্পাদক এর পদ জুটলেও সে ক্ষোভ-অভিমানে রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নেয় নিজেকে, কিছুদিন পরেই ৩৩ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে সে ছাত্রলীগ এর মুখ উজ্জ্বল করেছে। জাহিদ ভাই যদি আর ১০ জনের মত লেখাপড়া ছেড়ে কেবল রাজনীতিকেই ধ্যানজ্ঞান মানতো, তবে জীবনপথে হোঁচট খেত নিশ্চিত, যেমন হোচঁট খেয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে হাহুতাশ করছে সমসাময়িক অনেকেই!
তুমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান হয়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করেছো, এমনটা মোটেও নয় যে তোমার ধারণ করা আদর্শের চর্চা করতে, প্রিয় দল-সংগঠনকে সার্ভ করতে তোমাকে দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতি-ই করতে হবে, বরং যেকোনো পেশায় গিয়ে তুমি স্বীয় অবস্থান থেকে আদর্শ আর প্রিয় দলের জন্য কাজ করতে পারো। দেশকে এগিয়ে নিতে, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে রাজনীতি ছাড়াও যেকোনো প্লাটফর্ম থেকে অবদান রাখার যথেষ্ট সুযোগ আছে!
তাই, শুরু থেকেই ছাত্র রাজনীতির পাঠ নেয়ার পাশাপাশি লেখাপড়াটা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। যদি কেউ রাজনীতিকে লেখাপড়ার অন্তরায় হিসেবে দাড় করাতে চায় তবে তা স্রেফ ‘লেইম এক্সকিউজ’ ভিন্ন আর কিছুই নয়! বাংলাদেশ এর ছাত্ররাজনীতির আঁতুড়ঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার ছাত্র রাজনীতির কালচাল অর্থাৎ হলের গেস্ট রুম এটেইন, মধুর ক্যান্টিনের নিয়মিত রাজনৈতিক আড্ডা, মিটিং-মিছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেও বেশ ভালোভাবেই লেখাপড়াটা চালানো যায়।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আবাসিক হলে থাকা সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির একজন কর্মীকে সব মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন বড়জোর দুই থেকে আড়াইঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়, যার চেয়ে ঢের বেশি সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বা অহেতুক শুয়ে-বসে ব্যয় করে। এখানে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার কালচার নেই। সদিচ্ছা থাকলে রাজনীতিতে পুরো সক্রিয় থেকেও লেখাপড়ায় প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়। আমার অনুসারী, বঙ্গবন্ধু হলের প্রিয় অনুজ আশরাফের কথা মনে আছে, ছাত্রলীগ এর সবচেয়ে একটিভ কর্মীদের একজন হয়েও সে ডিপার্টমেন্টে অনার্স-মাষ্টার্স দুটোতেই ১ম শ্রেণীতে ১ম হয়েছিলো। চাইলে এমন অনেকের নাম অনায়াসেই বলা যাবে, ছাত্ররাজনীতি যাদের লেখাপড়ায় মোটেও অন্তরায় হয়নি, ‘একটিভ পলিটিকাল’ একজন হয়েও যারা প্রত্যাশানুযায়ী ফলাফল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছে। কারণ একটাই, তারা রাজনীতিকে ‘অপশনাল’ ধরে লেখাপড়াকে ‘কম্পালসারি’ ভেবেছিলো। তাই, রাজনীতির পদ-পরিচয়, পলিটিকাল হিসেবে সুযোগ-সুবিধা, প্রত্যাশিত ক্যারিয়ার মোটকথা সব সাফল্যই তাদের জীবনে ধরা দিয়েছে।
অনেক কথাই বলে ফেললাম, সারমর্ম হচ্ছে, আগে লেখাপড়া, পরে রাজনীতি। আল্লাহ্ না করুক, এত আবেগ-ভালোবাসা-শ্রম-ঘামের রাজনীতিতে বড় কর্তাদের হেয়ালীপনা, খেয়াল-খুশীতে বঞ্চিত হলেও যেন জীবন যুদ্ধে হার না মানতে হয়। তোমার অর্জিত জ্ঞান-বিদ্যা যেন হয় জীবন পথে চলার দিশারী!
বিবেকের তাড়না থেকে ভাবনার খোরাকি দিলাম, একটু ভেবো। ফের ভালোবাসা নিও… অনাগত আগামীর তরে অন্তঃপ্রাণ শুভকামনা হে প্রিয় অনুজ! ♥
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
কোন মন্তব্য নেই
আপনার মন্তব্য/মতামত প্রদান করার জন্য ধন্যবাদ।
জয়বাংলা নিউজ.নেট।