বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশনার ইতিহাসকথা
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। এ বইটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ, অধ্যাপক ফখরুল আলম এবং আমি যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর লেখা পাণ্ডুলিপি উদ্ধার এবং যত্নের সঙ্গে গভীর মমতায় রক্ষা করে সম্পাদনা ও প্রকাশনার মূল ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানাও এ কাজে ছিলেন তাঁর সহযোগী।
আমরা যখন এই কাজটি শুরু করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি সুধাসদনে তখন অবস্থান করতেন। নির্ধারিত দিনে আমরা প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত হতাম। কাজ হতো আনন্দময় ও আন্তরিক পরিবেশে। তবে কাজ করতে হতো খুব সিরিয়াসলি এবং সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পাণ্ডুলিপি তো আর কারো নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সকলে মিলে যখন কিছু কিছু করে পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল তখন তত্কালীন বিরোধী দলের নেত্রী নিজেই তা কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিতেন। তাঁর এই নিষ্ঠা এবং যুক্তি-দক্ষতা আমাদের অভিভূত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যের ইতিহাসের ধারায় এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইটিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর যে-আনুপূর্বিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন—সে সম্পর্কে স্বকীয় ভাষায় তাঁর জীবনকথার মাধ্যমে যে প্রাক-ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন তা বাঙালি জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অর্থাত্ ইতিহাসের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রটির উত্সমূলকে বুঝতে গেলে এ বইটি পাঠ অপরিহার্য। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের বৈশিষ্ট্য ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কৌশল সম্পর্কেও জানা যাবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম-পূর্ব পারিবারিক ইতিহাস দিয়ে শুরু করে তাঁর বাল্যকাল, স্কুলজীবন, গোপালগঞ্জে বাংলার তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়ের ইতিহাস এবং তাঁর ধাপে ধারে বেড়ে ওঠার নানা পর্যায় এত সুন্দর, আকর্ষণীয় ও অনবদ্য ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন—যা পড়ে বোঝা যায় তিনি যে একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ কিংবা অসাধারণ দক্ষ কর্মী ছিলেন শুধু তা-ই নয়, একজন নিপুণ লেখক হিসেবেও এ বইয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন। তাঁর প্রাণবন্ত জীবনবোধের দীপ্তিতে উজ্জ্বল এ বইটি সেজন্যই আমাদের বিশিষ্ট লেখক-গবেষক এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রশংসাধন্য হয়েছে। এর পাঠক শুধু যে বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন সম্পর্কে জানবেন তা-ই না, তাঁর জীবনবোধের গভীরতা, সাহস, যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা, সুরুচি এবং দুঃখী মানুষের প্রতি সীমাহীন দরদ সহমর্মিতার কথাও অনুধাবন করতে পারবেন। দেখা যাবে যে, তিনি কখনোই আবেগে আক্রান্ত হয়ে ভেসে যাননি, প্রতিটি ঘটনাকেই তিনি তাঁর মতো করে বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এবং তাঁর সে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাস্তবতার সঙ্গে ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ তিনি ইতিহাসের পটে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে যে আন্তরিকতায় তুলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে একজন তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। সেই সঙ্গে দেখা যাবে যে, কোনো ঘটনাকে তিনি একপেশেভাবে দেখেননি। ওই ঘটনার যে অন্য দিকও থাকতে পারে, সে দিকটাও তাঁর লেখায় পরস্ফুিট হয়েছে।
তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন তত্কালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে যান। সেখানে হালকা-পাতলা গড়নের যে-ছেলেটি এগিয়ে এসে অকপটে তাঁর স্কুল সংস্কারসহ নানা দাবি-দাওয়া তুলে ধরল তাঁদের সামনে—সেই ছেলেটিই পরবর্তীকালে কলকাতার ছাত্রজীবনে এক জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় রূপান্তরিত হলেন। লক্ষ করার বিষয়, তখন থেকেই তিনি শুধুমাত্র মেঠো বক্তৃতা এবং রাজনৈতিক স্লোগানে আচ্ছন্ন ছিলেন না। আবুল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মীদের আর্থ-সামাজিক প্রশিক্ষণ এবং নিজস্ব একটি পত্রিকার মাধ্যমে কর্মসূচিভিত্তিক আধুনিক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করেন। এই লক্ষ্যেই আবুল হাশিম সাহেব ‘মিল্লাত’ নামে কলকাতা থেকে একটি প্রগতিশীল খবরের কাগজ প্রকাশ করেন। শেখ সাহেব নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কাগজ বিক্রি করতেন। রাজনীতির প্রতি কতটা কমিটমেন্ট থাকলে এটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়।
নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকৃতিগতভাবেই যে শেখ মুজিবের ভেতরে ছিল তা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মতো বিজ্ঞ নেতার চোখ এড়ায়নি; তিনি তাঁর নোটবুকে সেদিনই তাই লিখে নিয়েছিলেন—‘শেখ মুজিবর রহমান’ পরবর্তীকালে সম্ভাবনাময় এক নেতা। কলকাতায় গিয়ে তরুণ মুজিব যখন সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে এলেন সেখানেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে একজন বিখ্যাত বাঙালি ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর নাম সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি কলকাতা ছাড়াও দিল্লি করাচিতে যখন যেখানেই রাজনৈতিক যে বিষয়ে যোগদান করেছেন—সেখানেই স্বকীয় নেতৃত্বের গুণাবলির স্বাক্ষর রেখেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি যে কাজটি বিশেষভাবে করার চেষ্টা করতেন তা হলো—পূর্ববাংলা যাতে উপেক্ষিত না হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশেষ করে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন—তিনি যেন বাংলার কথা বলেন। অবিভক্ত ভারতের কলকাতা এবং বিহারে দাঙ্গা হওয়ার পর তিনি যেভাবে রাতদিন দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় কাজ করেছেন তা লক্ষ করার মতো। সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধেও তাঁর অবস্থান ছিল পরিষ্কার। ১৯৬৪ সালে ঢাকার দাঙ্গা-পীড়িতদের ত্রাতা ছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনেও এই বিভেদের, এই নরহত্যার কোনো স্থান নেই। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া একটি দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়—এই ছিল তাঁর মূল রাষ্ট্রদর্শন। সোহ্রাওয়ার্দী, শরত্ বসু, আবুল হাশিম প্রমুখ বৃহত্ বাংলার যে-আন্দোলনে জড়িত ছিলেন সেটা ব্যর্থ হওয়ার পরই মূলত তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই তত্কালীন কেন্দ্রীয় নেতাদের বিশেষ করে লিয়াকত আলী খানদের আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝে ফেললেন যে, ‘আমরা প্রতারিত হয়েছি’। স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে আসার আগে কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোটেলে তাঁর ভগ্নিপতি ও রাজনীতিক আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে তাই বলেছিলেন, ‘আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তাতে পূর্ব বাংলার কোনো কল্যাণ হবে না। অতএব আমাদের আবার নতুন করে সংগ্রাম করতে হবে।’
সেই সংগ্রামের অভিপ্রায় নিয়েই তিনি ঢাকায় এলেন এবং ছাত্রলীগ গঠন করলেন। ধীরে ধীরে গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯)। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন (১৯৫৫) কারণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কী ভয়াবহ হতে পারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। সেজন্যই তিনি এবার যথেষ্ট সতর্ক হলেন এবং আজীবন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েই সুপরিকল্পিত সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। অসংখ্য জেল-নির্যাতন ভোগ করে পারিবারিক শান্তি বিসর্জন দিয়ে বহু ত্যাগের মাধ্যমে শেষে তাঁর আজীবনের স্বপ্নের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যাঁরা পড়বেন, তাঁরা একজন দক্ষ লেখকের জীবনকাহিনিতে বাংলার ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটতে পারবেন অবলীলায়। দেখবেন একেবারেই আমাদের সেই পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমানকে; পরবর্তীকালে যিনি বঙ্গবন্ধুরূপে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতা করার ঢং, কথা বলার ধরন এবং শেকড়সংলগ্নতা একইভাবে এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। এ বই পড়ে মনে হয়, যিনি এ ধরনের আত্মজীবনী লিখতে পারেন, তাঁর পক্ষেই মূলত ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের অমন ভাষণ দেওয়া সম্ভব। সেই অসাধারণ নেতার অসামান্য আত্মজীবনী তাই জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এতদিন এটি ছিল আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি, এখন জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে।’
লেখক :মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
শামসুজ্জামান খান১৫ আগষ্ট, ২০১৮ ইং
কোন মন্তব্য নেই
আপনার মন্তব্য/মতামত প্রদান করার জন্য ধন্যবাদ।
জয়বাংলা নিউজ.নেট।